কিডনি হচ্ছে আমাদের মানব দেহের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। কিডনি রক্তে দূষিত পদার্থগুলো পরীশোধন করে প্রস্রাবের মাধ্যমে সেটা দেহ থেকে বাহির করে দেয়।কিডনিতে অনেক সময় অনেক ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে যেটাকে অনেকেই আমরা কিডনি রোগ হিসেবে চিনে থাকি। অনেকের ক্ষেত্রে কিডনি রোগ কোন ধরনের উপসর্গ ছাড়াই এসে থাকে। কিডনি রোগের কিছু ঘরোয়া চিকিৎসা রয়েছে যার মাধ্যমে কিডনিকে সুরক্ষিত রাখা যায়।
আজকের আর্টিকেলে কিডনি রোগের ঘরোয়া চিকিৎসা, কিডনি রোগ কেন হয়, কিডনি রোগের লক্ষণ ও কিডনি রোগের খাবার তালিকা নিয়ে কিছু মূল্যবান তথ্য তুলে ধরা হয়েছেঃ
কিডনি রোগ কেন হয়?
উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ইউরিন ইনফেকশন, কিডনিতে পাথর সহ আরো অনেক কারণে কিডনি রোগ হতে পারে। তাছাড়া যারা নিয়মিত অতিরিক্ত পরিশ্রম করে, কোন কাজ করেন না অর্থাৎ ব্যায়াম করেন না, কম পানি খাওয়া ও ধূমপান করার জন্য কিডনি রোগ হতে পারে। তাছাড়া অনেক সময় পরিবারের কারো কিডনি রোগ থেকে থাকলে অন্যদের হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
কিডনি রোগের লক্ষণ?
কিডনি রোগ দেখা দিলে কিছু লক্ষণ প্রকাশ পেয়ে থাকে। এই লক্ষণ গুলোর মাধ্যমে খুব সহজেই কিডনি রোগীকে শনাক্ত করা যায়। আবার অনেকের শরীরে লক্ষণ ছাড়াই কিডনি রোগ বাসা বেধে থাকেঃ
- প্রস্রাবের পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কমে যায়।
- প্রস্রাব লাল হয় ও প্রস্রাবের সাথে রক্ত যায়।
- কোমরে দুই পাশে ব্যাথা হয়ে থাকে ও অনেকের তলপেটে ব্যাথা হয়।
- উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা থাকে।
- শরীর ও পা ফুলে যায়, তাছাড়া অনেক রোগীর মুখ ফুলে যায়।
- মনোযোগ কমে যায় ও শরীরে ক্লান্তি ভাব আসে।
- বমি বমি ভাব পায় ও মাঝেমধ্যেই মাথা ব্যাথার সমস্যা হয়।
- হঠাৎ করেই ওজন কমে যায়।
- শরীরের বিভিন্ন অংশে চুলকানি ও র্যাশ তৈরি হয়।
- সব সময় শীত শীত লাগে।
কিডনি রোগীদের ক্ষেত্রে এই উপসর্গগুলো অনেক সময় দেখা যায়। তাই কারো এই উপসর্গ গুলো দেখা দিলে অবশ্যই কিডনি পরীক্ষা করানো উচিত।
কিডনি রোগীর খাদ্য তালিকা pdf | কিডনি রোগীর খাবার তালিকা
কিডনি রোগীর খাবার তালিকা অবশ্যই সঠিক হতে হবে। কেননা কিডনি রোগের খাবার তালিকা যদি ভুল হয়ে থাকে তাহলে সমস্যা আরো বাড়তে পারে। নিম্নে কিডনি রোগীর খাবার তালিকা তুলে ধরা হলঃ
- কিডনি রোগীকে সকল সময় কম লবন ও সোডিয়ামযুক্ত খাবার খাওয়াতে হবে।
- কম ফসফরাস যুক্ত খাবার ও তরল পানীয় পান করতে হবে।
- সঠিক পরিমাণে পটাশিয়ামযুক্ত খাবার বেছে নিতে হবে।
- সঠিক প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করবে।
- হার্টের জন্য স্বাস্থ্যকর খাবার গুলিকে বেছে নিতে হবে।
- অ্যালকোহল জাতীয় খাবার বাদ দিতে হবে।
- নোনতা খাবার বাদ দিতে হবে।
- শস্যজাতীয় কার্বোহাইড্রেট খাবার গ্রহণ করতে হবে।
নিম্নে কিডনি রোগীরা কোন খাবার কতটুকু পরিমাণে গ্রহণ করতে পারবে এই বিষয়ে কিছু তথ্য দেওয়া হলঃ
- সোডিয়াম সমৃদ্ধ খাবার প্রতিদিন ২০০ গ্রামের কম খেতে হবে।
- পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার প্রতিদিন ২০০ গ্রামের কম খেতে হবে।
- ফসফরাস প্রতিদিন ৮০০ থেকে ১০০০ মিলিগ্রামের কম হতে হবে।
তাছাড়া নিম্নে কিডনি রোগীর খাবার তালিকার বিষয়ে আরো কিছু তথ্য দেওয়া হলোঃ
- ফুলকপি
- শালগম
- মুলা
- বাঁধাকপি
- মাশরুম
- পেঁয়াজ
- বেল মরিচ
- রসুন
- ব্লুবেরি
- লাল আঙ্গুর
- আনারস
- জলপাই তেল
- ডিমের সাদা অংশ
- চামরাহীন মুরগি
- ত্রাণবেরি
যাদের কিডনি রোগ রয়েছে তারা চাইলে এই খাবারগুলো নিঃসন্দেহে খেতে পারবেন।
কিডনি রোগী কি কি ফল খেতে পারবে?
কিডনি রোগীরা অবশ্যই ফল খেতে পারবে। তবে কিছু ফল রয়েছে যেগুলো কিডনি রোগ হলে কম পরিমাণে খেতে হবে। কিডনি রোগীদের লেবু, মালটা, আঙ্গুর, আমলকি, কলা, শুকনো ফলমূল এগুলো কম পরিমাণে খেতে হবে।
অন্যদিকে তারা চাইলে আপেল, পেয়ারা, বেদানা, নাশপাতি, আঙ্গুর ইত্যাদি পরিমিত পরিমাণে খেতে পারেন।
কিডনি রোগী কি দুধ খেতে পারব?
কিডনি রোগীদের অনেক ক্ষেত্রে কার্বোহাইড্রাইড জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়ে থাকেন ডাক্তাররা। যেহেতু দুধে কার্বোহাইড্রেট রয়েছে তাই দুধ খেলে খুবই কম পরিমাণে খেতে হবে। বেশি পরিমাণে দুধ খেলে এই সময় কিডনির সমস্যা আরো বাড়তে পারে।
কিডনি রোগী কি মাছ খেতে পারবে?
কিডনি রোগী অবশ্যই মাছ খেতে পারবে। কিডনি রোগীদের মাছ খাওয়ার ক্ষেত্রে কোন বিধি-নিষেধ নেই। কিডনি সমস্যা থাকলে রাতে দুই টুকরা মাছ খাওয়া যেতে পারে। তবে কখনোই এই সময়টাতে অতিরিক্ত পরিমাণে মাছ খাওয়া যাবে না।
কিডনি রোগী কি দই খেতে পারবে?
কিডনি রোগীদের অবশ্যই প্রোটিন নিয়ন্ত্রিত পরিমাণে খেতে হবে। কিডনি রোগীদের দই খাওয়ার জন্য কোন নিষেধ নেই। কিডনি রোগীরা চাইলে প্রতিদিন অল্প পরিমাণে দই খেতে পারেন এতে কোন সমস্যা সৃষ্টি হবে না।
কিডনি রোগী কি খেজুর খেতে পারবে?
অনেকে কিডনি রোগীরা কি খেজুর খেতে পারবে এই বিষয়ে প্রশ্ন করে থাকেন। খেজুর খুবই পুষ্টিকর একটি খাদ্য উপাদান। কিডনি রোগীদের জন্য খেজুর খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকে। তাই কিডনি রোগীরা খেজুর খেলে কোন ধরনের সমস্যা হবে না।
কিডনি রোগের ঘরোয়া চিকিৎসা?
কিডনি রোগীরা ঘরোয়া পদ্ধতিতে চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারে। ঘরোয়া কিছু উপাদান ব্যবহার করেই কিডনি রোগীরা নিজেদেরকে সুরক্ষিত রাখতে পারবেন।
আদা
কিডনি রোগীদের জন্য আদা দারুণ একটি উপাদান। আদাতে রয়েছে জিনজোরোলস যা ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে থাকে। কিডনি রোগীরা প্রতিদিন নিয়ম করে আদা চা সেবন করতে পারেন। তবে কখনো দিনে ৪ গ্রামের বেশি আদা খাবেন না।
আপেল
আপেলে থাকা এসিড কিডনিতে এসিডের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে থাকে। যার ফলে কিডনিতে সহজে ব্যাকটেরিয়া জন্মতা পারে না। তাই কিডনি রোগ হলে প্রতিদিন একটি করে আপেল অথবা আপেলের জুস করে খাওয়া যেতে পারে।
অ্যালোভেরা
কিডনি রোগ নিরাময় করার জন্য এলোভেরা খুবই কার্যকারী একটি উপাদান। কেননা এলোভেরা আমাদের শরীর থেকে টক্সিন বের করে দেয়।
তাই কিডনি রোগীরা প্রতিদিন নিয়ম করে অ্যালোভেরারের জুস খেতে পারেন। তবে অল্প পরিমাণে অ্যালোভেরার জুস খেতে হবে না হলে কিডনির সমস্যা আরো বাড়তে পারে।
আপেল সিডার ভিনেগার
আপেল সিডার ভিনেগারে রয়েছে ম্যালিক এসিড ও এন্টি ব্যাকটেরিয়াল উপাদান। তাই এটি কিডনি রোগীদের জন্য দারুন একটি খাবার হতে পারে।
কিডনিতে ইনফেকশন বা ব্যথা থাকলে প্রতিদিন দুই চামচ করে ভিনেগার এক গ্লাস পানিতে মিশিয়ে পান করতে পারেন। তাহলে কিডনি রোগীদের কিডনি সুস্থ থাকবে।
কিডনি রোগের ঔষধের নাম?
অনেকেই কিডনি রোগের ঔষধের নাম সম্পর্কে জানতে চান।কিডনি রোগীদের জন্য বেশ কিছু ঔষধ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমনঃ
- Ramipril
- Iron
- losatran
- amlodipine
- calcium acetate
- alfacalcidol
- furosemide
কিডনি রোগীদের ক্ষেত্রে ডাক্তার অনেক সময় এই ওষুধগুলো খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তবে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী কিডনি রোগীদের ওষুধ সেবন করতে হবে না হলে বড় ধরনের সমস্যা হতে পারে।
কিডনি রোগের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা?
কিডনি রোগীদের জন্য হোমিওপ্যাথিতে দারুন ও কার্যকারী ঔষধ রয়েছে। তাছাড়া হোমিওপ্যাথি কিডনি রোগের চিকিৎসায় দারুন কাজ করে থাকে। যাদের কিডনির সমস্যা রয়েছে তারা অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ঔষধ সেবন করবেন।
কিডনি রোগীরা কোন ধরনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ছাড়াই হোমিওপ্যাথি ঔষধ খাওয়ার মাধ্যমে রোগটি থেকে পরিত্রাণ পাবেন।
কিডনি রোগের ভেষজ ঔষধ?
অনেকে কিডনি রোগের ভেষজ ঔষধের সন্ধান করে থাকেন। কিডনি রোগ থাকলে নিম্ন দেওয়া ভেজস ঔষধ গুলো ব্যবহার করতে পারেঃ
ধনেপাতা
কিডনি রোগীদের জন্য ধনেপাতা খুবই দারুণ একটি উপাদান। অনেক বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের মধ্যে এই উপাদানটি কিডনি সুস্থ রাখতে সাহায্য করে থাকে। প্রতিদিন খাবারে ধনেপাতা ধনে গুঁড়ো করে ব্যবহার করলে কিডনির কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।
হলুদ
কিডনি রোগীদের জন্য হলুদ হচ্ছে খুবই কার্যকারী একটি ভেষজ। হলুদে থাকা শক্তিশালী বিভিন্ন উপাদান হার্ট, লিভার ও কিডনিকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে থাকে।
নিয়মমাফিক হলুদ সেবন করার মাধ্যমে কিডনি সংক্রমণকে অনেক দূরে রাখা যায়। তাই কিডনির সুরক্ষার জন্য হলুদ খাওয়া যেতে পারে।
ত্রিফলা
ত্রিফলা হচ্ছে আয়ুর্বেদের সবথেকে কার্যকরী একটি ঔষধ। ত্রিফলা একাধিক রোগ নিরাময়ের জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে। নিয়মিত ত্রিফলা সেবনে লিভার ও কিডনি সুস্থ থাকে। তাই কিডনির কার্যক্ষমতা উন্নত করতে ত্রিফলা সেবন করা যেতে পারে।
কিডনি রোগী কতদিন বাঁচে?
কিডনি রোগীকে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে দীর্ঘদিন সুস্থ রাখা যায়। বিশেষ করে যেসব রোগীদের অপারেশন করা হয় তাদের চিকিৎসা দিয়ে অনেকদিন সুস্থ করে রাখতে পারা যায়।
তবে কিডনি ডায়ালসিস ও কিডনি ট্রান্সলেটের মাধ্যমে রোগী ২০ থেকে ২৫ বছর সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকতে পারবেন। তবে এটা কিডনি রোগীদের জন্য খুবই খরচ সাপেক্ষ একটি চিকিৎসা।
শেষ কথা, কিডনি রোগের ঘরোয়া চিকিৎসা বা কিডনি রোগ কেন হয় ও কিডনি রোগের লক্ষণ সম্পর্কে হয়তো ইতিমধ্যে জেনে গিয়েছেন।
তাই কিডনি সুস্থ রাখার জন্য অবশ্যই আমাদেরকে বাড়তি সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে এবং কিডনিতে কোন ধরনের সমস্যা বা রোগ হলে ডাক্তারের কাছে গিয়ে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।