পিত্তথলিতে পাথর হওয়া আমাদের খুবই পরিচিত একটি সমস্যা। এমন রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। পিত্তথলিতে পাথরের সমস্যা আমাদের অনেকেরই হয়ে থাকে। কিন্তু আমরা অনেকেই পিত্তথলিতে পাথর হয়েছে এমনটি বুঝতে পারি না।এমনকি তার লক্ষণ দেখা দিলে বুঝতে পারি না। দেহে নীরবেই এর প্রতিক্রিয়ায় আপনার নানা ধরনের রোগ ডেকে আনতে পারে। আজকের আর্টিকেলে পিত্তথলির পাথর নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
পিত্তথলির পাথর কি?
পিত্তথলির পাথর হচ্ছে পিত্তাশয়ের এমন একটি রোগ। যাতে মানুষের পিত্তাশয়ে পাথর জমা হয়। ইহা কোলেলিথিয়াসিস নামে চিকিৎসা বিজ্ঞানে পরিচিত। উন্নত দেশে প্রায় ১০ থেকে ২০% প্রাপ্তবয়স্ক লোক এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে।
আমেরিকাতে প্রায় ২০ মিলিয়ন ব্যক্তির পিত্তথলিতে পাথর পাওয়া যায়। যার মোট ওজন হতে পারে প্রায় ২৫ থেকে ৫০ টন। ৮০% এরও বেশি ক্ষেত্রে পিত্তথলির পাথর কোন জটিলতা বা সমস্যার সৃষ্টি করে না।
মানব শরীরে মূলত কোলেস্টেরল এবং পিগমেন্ট এই ২ ধরনের পাথর পাওয়া যায়। উন্নত বিশ্বে ৯০% পাথরই কোলেস্টেরল দিয়ে তৈরি। বাদবাকি পিগমেন্ট পাথর ও অনেকসময় মিশ্র পাথরও পাওয়া যায়। তবে পিগমেন্ট পাথরের প্রাদুর্ভাবটা এশিয়া মহাদেশে বেশি পাওয়া যায়।
পিত্তথলিতে পাথর আসলে কি?
পিত্তথলির পাথর হল ছোট ছোট বালুর দানার মতো থেকে শুরু করে মটরের দানা অথবা তার চেয়েও বড় শক্ত দানাদার বস্তু। যা বিভিন্ন রঙের এবং বিভিন্ন আকৃতির হতে পারে। ইহা নির্ভর করে কি পদার্থ দিয়ে পাথরটা তৈরি তার ওপর।
কোলেস্টেরল, বিলিরুবিন অথবা ক্যালসিয়াম ইত্যাদি পদার্থের সংমিশ্রণে তৈরি এই পাথরগুলো পিত্তরসের সাথে মেশানো অবস্থায় থাকে ও হালকা বাদামি, ময়লাটে সাদা অথবা কুচকুচে কালো রঙেরও হতে পারে।
পিত্তথলির পাথর কেন হয়?
পিত্তথলির পাথর হওয়ার বিভিন্ন ধরনের কারণ থাকতে পারে। তবে পিত্তরস যদি কারও ঘন হয়, তাহলে তার পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। সাধারণত নিচে উল্লেখিত কারণে পিত্তথলিতে পাথর হতে পারেঃ
- পানি কম খেলে
- শারীরিক পরিশ্রম কম করলে
- স্থূলকায় সমস্যা থাকলে
- রক্ত বেশি ভাঙলে
- শরীরে চর্বি বেশি জমলে
- নিয়মিত যেসব নারীরা পিল খায়
- দীর্ঘদিন গ্যাস্ট্রিকের ঔষুধ খেলে
পিত্তথলির পাথর এর লক্ষণ?
- ডান কাঁধে ব্যাথা
- উপরের ডানদিকে পেটে তীব্র ব্যকথা
- বমি হওয়া
- বমি বমি ভাব
- কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসতে পারে
- জ্বরের সঙ্গে জন্ডিস হতে পারে
- কাঁধের মধ্যে পিঠে ব্যাথা
- মধ্য পেটে ব্যথা হয়
পিত্তথলির কাজ কি?
যকৃত কিংবা লিভারে পিত্তরস বা বাইল তৈরি হয়। ছোট নালীর মাধ্যমে এই রস পিত্তথলিতে জমা হয়। আর আমরা যখন চর্বি জাতীয় খাবার খাই, তখন কোলেসিস্টোবাইনিন নামে এক ধরনের হরমোন নিঃসরণ হয়।
এই হরমোনের প্রভাবে পিত্তথলি সঙ্কোচিত হয় ও জমা থাকা রস বের করে দেয়। পরে এই রস ক্ষুদ্রাতন্ত্রে গিয়ে খাদ্য হজমে সাহায্য করে থাকে।
পিত্তথলির চিকিৎসা?
প্রদাহ এবং তীব্র ব্যথার সময় কোন অস্ত্রোপচার করা হয় না। আর এ অবস্থায় সাধারণত কয়েক দিনের জন্য মুখে খাদ্য গ্রহণ বন্ধ করে দিয়ে স্যালাইন, অ্যান্টিবায়োটিক এবং ব্যথানাশক ওষুধ দিয়ে প্রাথমিক উপশমের চেষ্টা করা হয়।
পিত্তথলি ফেলে দেওয়ার অস্ত্রোপচার সপ্তাহ দুয়েক পর বা দু থেকে তিন মাস পর করলেও ক্ষতি নেই। পেট কেটে অথবা ফুটো করে দুইভাবেই এই অস্ত্রোপচার করা যায়। তবে পিত্তনালিতে পাথর আটকে গিয়ে থাকলে ইআরসিপি যন্ত্রের সাহায্যে এ পাথর বের করে আনা হয়।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে পিত্তথলির পাথরে চিকিৎসার প্রধান উপাদান হচ্ছে অপারেশন। এ অপারেশন দুই ভাবে করা যায়ঃ
- সরাসরি পেট কেটে
- লেপারস্কোপিক মেশিনের সাহায্যে
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জগতে লেপারস্কোপিক পদ্ধতি হল খুবই সুবিধাজনক। ল্যাপারস্কোপির অর্থ হচ্ছে ক্যামেরা দিয়ে দেখা।
পেটের যে অংশে পিত্তথলি অবস্থিত সেখানে ছোট ছোট ছিদ্র করে সূক্ষ্ম সরু যন্ত্র দিয়ে পিত্তথলির পাথর অপসারণ করা হয়। আর এতে অপারেশনের পর ব্যাথা এবং রক্তক্ষরণ কম হয়। রোগী ২ এক দিনের মধ্যে ভাল হয়ে যায়।
পিত্তথলির পাথর দূর করার ঘরোয়া উপায়?
নিচে কিছু প্রাকৃতিক প্রতিকার উল্লেখ করবো যেগুলো আপনাকে পিত্তথলির পাথর গলাতে সাহায্য খুবই সাহায্য করবেঃ
মূলা
নিয়মিত আপনি যদি মূলা খান, তবে আপনার পিত্তথলির পাথর দূর হয়ে যাবে। মূল্ আপনার পিত্তথলিতে পাথর তৈরিতে বাঁধা দিয়ে থাকে।
লেবুর রস
পেটের যেকোনো রোগ সারাতে লেবুর কোন বিকল্প হয় না। লেবুতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি। গলব্লাডারে স্টোন আটকাতে লেবুর রস নিয়মিত খেতে হবে।
আপনি প্রতিদিন খালি পেটে এক গ্লাস পানির সাথে লেবুর রস মিশিয়ে নিয়মিত খেতে পারেন এতে করে আপনার পিত্তথলির পাথর গলে যাবে ধীরে ধীরে। নিয়মিত এই লেবুর রস ও পানি খেলে আপনার পিত্তথলিতে কখনো পাথর হবে না।
ক্র্যানবেরির জুস
পিত্তথলির পাথর দূর করতে এই জুস অনেক কার্যকরী। এটি খেলে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে থাকে যার ফলে পিত্তথলিতে আর কখনো পাথর হয় না।
হলুদ
নিয়মিত কাঁচা হলুদ খেলে আপনার পিত্তরস ঠিক থাকবে। কারণ কাঁচা হলুদের রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এর সকল গুণ। তাই আপনাকে রোজ সকালে খালি পেটে মধুর সঙ্গে কাঁচা হলুদ মিশিয়ে মিশ্রণ করে খেতে হবে।
নারিকেল তেল
পিত্তথলির পাথর দূর করতে নারকেল তেল খুবই কার্যকরী। ৩ চা চামচ নারিকেল তেলের সাথে ১টি গ্লাসের ১ চতুর্থাংশ আপেলের রস ও ৫টি রসুনের কোয়া ও সাথে এক টুকরো আদা মিশিয়ে মিশ্রণ তৈরি করে খান।
আপনি এই মিশ্রণ ব্লেন্ডার মেশিন দিয়ে ভালভাবে তৈরি করতে পারেন। ইহা নিয়মিত খেলে আপনার পিত্তথলির পাথর গলে যাবে।
পিত্তথলির অবস্থান?
মানব দেহের বুকের পাজরের ডান দিকে পেটের ওপরে অংশের যকৃত বা লিভার অথবা কলিজার নিচে পিত্তথলি যুক্ত থাকে।
বাংলাদেশে পিত্তথলির পাথর অপারেশন খরচ কত?
বাংলাদেশে পিত্তথলির পাথর অপারেশন খরচ ২৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা হয়।
পিত্তথলির পাথর গলানোর হোমিওপ্যাথি ঔষধ | পিত্তথলির পাথর গলানোর ঔষধ
- Chelidonium Majus
- Chinonanthus V
- Berberis Vul
এই ৩টি ওষুধের মিশ্রণে একটি ওষুধ তৈরি করতে হবে। আর এজন্য বাজার থেকে ১০০ মিলি গ্রামের ১টি কাঁচের বোতল কিনে আনতে হবে।
বিঃদ্রঃ পিত্তথলির পাথর দূর করতে সাধারণত অপারেশন প্রয়োজন হয়। এই রোগটি অনেক জটিল। আর তাই ১ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া শুধুমাত্র গুগল অথবা ইউটিউব সার্চ করে কোন ধরনের ওষুধ সেবন করবেন না।
পিত্তথলির পাথর রোগটি কাদের বেশি হয়?
স্থূল এবং ওজনাধিক্য ব্যক্তিদের পিত্তথলিতে পাথর সবচেয়ে বেশি হতে দেখা যায়। পুরুষদের তুলনায় নারীদের এই রোগের প্রবণতা বেশি।
এছাড়া চল্লিশোর্ধ্ব বয়স, জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি খাওয়ার অভ্যাস, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাদ্য গ্রহণ ইত্যাদি এই ঝুঁকিসমূহ এ রোগ বাড়িয়ে দেয়।