জন্ডিস বিভিন্ন কারণে হতে পারে। ভাইরাস থেকে শুরু করে নানান ধরনের ঔষধ ও মাত্রাতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবনের কারণে জন্ডিসের সমস্যা দেখা দিতে পারে। জন্ডিস নিজে কোন রোগ না হলেও এটি রোগের লক্ষণ হিসেবে প্রকাশ পেয়ে থাকে।জন্ডিসকে আমরা অনেকেই লিভারের প্রদাহ হিসেবে চিনে থাকি। লিভার প্রদাহের কারণ হচ্ছে হেপাটাইটিস ই, এ ও বি ভাইরাসের কারণে। জন্ডিস হলে অবশ্যই সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা করা উচিত না হলে পরবর্তীতে মারাত্মক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
আজকের পোস্টে জন্ডিস কেন হয়, জন্ডিস হলে কি কি সমস্যা হয়,জন্ডিস রোগের খাবার তালিকা ও জন্ডিসের ঘরোয়া চিকিৎসা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেওয়া হবে। তাহলে চলুন দেরি না করে জেনে নেওয়া যাকঃ
জন্ডিস কেন হয়?
জন্ডিস সাধারণত রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা যখন অনেকাংশে বেড়ে যায় তখন হয়ে থাকে। আমাদের রক্তের লোহিত কনাগুলো এক সময় ভেঙে যায়। তারপরে বিলিরুবিন তৈরি করে যা পরবর্তী সময়ে লিভারে প্রক্রিয়াজাত হয়ে পিত্তরসের সাথে পিত্ত নলির মাধ্যমে পরিপাকতন্ত্রে প্রবেশ করে থাকে।
তারপরে অন্ত্র থেকে বিলিরুবিন পায়খানার মাধ্যমে শরীর থেকে বেরিয়ে আসে। বিলিরুবিনের এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় যেকোনো অসংগতি দেখা দিলে রক্তে বিলুরুবিন বেড়ে যায় আর দেখা দিয়ে থাকে জন্ডিস। জন্ডিস রোগীদের চামড়া অনেকটা ফ্যাকাশে হয়ে যায় ও হলুদ বর্ণ ধারণ করে থাকে।
জন্ডিস হলে কি কি সমস্যা হয়?
জন্ডিস হলে আমাদের শরীরের কিছু লক্ষণ প্রকাশ পেয়ে থাকে। জন্ডিস হলে রোগীদের চোখ অনেকটা হলুদ হয়ে যায়। তাছাড়া জন্ডিস হলে রোগীদের ক্ষুধা কমে যায়, অরুচির সমস্যা হয়ে থাকে, বমি বমি ভাব হয়ে থাকে।
কিছু কিছু জন্ডিস রোগীর ক্ষেত্রে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসা,ও তীব্র পেট ব্যথার সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। চিকিৎসক খুব সহজেই শারীরিক তীব্রতা ও রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে রোগীর জন্ডিস কি পর্যায়ে রয়েছে সেটা বুঝতে পারেন।
জন্ডিসের ঘরোয়া চিকিৎসা?
জন্ডিস হলে শরীর ধীরে ধীরে খারাপ হতে থাকে। তাছাড়া ক্ষুধা অনেক কমে যায় ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক দুর্বল হয়ে যায়। জন্ডিস প্রতিকারের জন্য কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারেঃ
গ্রিন টি
গ্রিন টি রক্তে বিলুরুবিনের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে থাকে। গ্রিন টি তে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আমাদের শরীরের জন্য খুবই উপকারী একটি উপাদান।
তাই যাদের জন্ডিস হয়েছে তারা নিয়মিত গ্রিন টি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন তাহলে অনেক উপকার পাওয়া যাবে।
ধনে
সারা রাত একটি গ্লাসে অল্পসংখ্যক গোটা ধনে ভিজিয়ে রাখতে হবে। তারপরে সকালে উঠে এই জল পান করতে হবে। এই উপাদানটি জন্ডিস কমাতে দারুণ কাজ করে থাকে। উপাদানটি নিয়মিত সেবন করার মাধ্যমে অল্প সময়ের মধ্যে জন্ডিসের সমস্যা দূর হবে।
ত্রিফলা চূর্ণ
রাতে এক গ্লাস ত্রিফলা চূর্ণ এক গ্লাস পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে সেই জল পান করতে হবে। এভাবে নিয়মিত কিছুদিন পান করলে খুব সহজে জন্ডিসের সমস্যা দূর হয়ে যাবে।
আখের রস
আখের রস জন্ডিসের সমস্যা কমাতে দারুন ও কার্যকারী একটি উপাদান। তাছাড়া জন্ডিস সাড়াতে আখের রসের পাশাপাশি লেবু ও কমলা লেবুর রস নিয়মিত সেবন করতে পারেন তাহলে অনেক উপকার পাবেন।
করলার পাতা
প্রথমে একটি পাত্রে এক কাপ জলে ৭ থেকে ১০ টি করলার পাতা নিতে হবে। তারপরে আধা লিটার পরিমাণ জলে করলার পাতা সিদ্ধ করতে হবে। জন্ডিস দূর করার জন্য এই পানি দিনে অন্তত তিনবার ব্যবহার করতে পারেন।
পেপে পাতা
প্রথমে পেপে পাতার পেস্টে এক চামচ মধু মিশিয়ে নিতে হবে। তারপরে এটি এক বা দুই সপ্তাহ নিয়মিত খেয়ে যেতে হবে। এটি জন্ডিস নিরাময় করার জন্য খুবই কার্যকারী একটি চিকিৎসা।
তুলসী পাতা
তুলসী পাতার রয়েছে অসংখ্য গুন। তুলসী পাতা জন্ডিস সাড়াতেও দারুন কাজ করে থাকে। প্রথমে ১০ থেকে ১৫ টি তুলসী পাতা নিতে হবে এবং এটা পেস্ট তৈরি করে ফেলতে হবে। তারপরে এর সাথে আধা গ্লাস মুলা পাতার রস যোগ করতে হবে।
ভালো ফলাফলের জন্য প্রতিদিন এই পানিওটি পান করতে হবে। একটানা এক সপ্তাহ খেলে খুব সহজেই রেজাল্ট টা দেখতে পারবেন।
জন্ডিস হলে কি ডিম খাওয়া যাবে?
অনেক জন্ডিস রোগীর প্রশ্ন রয়েছে জন্ডিস হলে কি ডিম খাওয়া যাবে? বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের পরামর্শ অনুযায়ী জন্ডিস হলে ফ্যাট জাতীয় খাবার কম খেতে হবে। ডিম ও মাখন এগুলো সবই ফ্যাট জাতীয় খাবার।
তাই অবশ্যই জন্ডিস রোগীদের এই সকল খাবার কম করে খেতে হবে তাহলে শরীরের কোন ধরনের ক্ষতি হবে না। যদি অতিরিক্ত ফ্যাট জাতীয় খাবার খাওয়া হয় এই সময়টাতে তাহলে শরীরে এর বিরুপ প্রভাব দেখা দিতে পারে।
জন্ডিস হলে কি স্যালাইন খাওয়া যাবে?
জন্ডিস হলে সকল সময় চেষ্টা করতে হবে গরম পানি ফুটিয়ে খাওয়ার জন্য। কেননা এই সময়ে দূষিত পানি পেটে গেলে সমস্যা আরো বাড়তে পারে। জন্ডিস রোগীদের অনেকের প্রশ্ন রয়েছে জন্ডিস থাকাকালীন স্যালাইন খাওয়া যাবে কিনা।
জন্ডিস আক্রান্ত রোগীদের প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। তাই জন্ডিস আক্রান্ত রোগীরা যদি এই সময়ে স্যালাইনের পানি খায় তাহলে কোন সমস্যা নেই।
জন্ডিস রোগীর খাবার তালিকা?
জন্ডিস রোগীদের অবশ্যই খাবারের দিকে একটু বাড়তি নজর দিতে হবে। কেননা এই সময়টাতে কিছু খাবার এড়িয়ে চলতে হবে এবং কিছু খাবার নিয়মিত খেতে হবে। নিচে জন্ডিস রোগীদের খাবার তালিকা তুলে ধরা হলোঃ
গোটা শস্য খেতে পারেন
জন্ডিস হলে প্রচুর পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার খেতে হবে। কার্বোহাইড্রেটের চাহিদা পূরণে বাদামি চাল রুটি ওটস খাওয়া যেতে পারে। গোটা শস্য তে প্রচুর পরিমাণে আশ থাকে যার মাধ্যমে শরীর থেকে ক্ষতিকর টক্সিন দূর হয়ে যায়।
প্রচুর পরিমাণে সবজি খেতে হবে
জন্ডিস রোগীদেরকে ডাক্তাররা সবজি খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। সবজি তালিকার মধ্যে মিষ্টি কুমড়া, মিষ্টি আলু, বিট, গাজর, ফুলকপি,বাঁধাকপি, টমেটো, ও পালংশাক জন্ডিস রোগীদের জন্য খুবই ভালো।
প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে
খাদ্য তালিকায় প্রতিদিন মাছ মুরগির মাংস ও ডাল পরিমাণ মতো রাখতে হবে। না হলে রোগী ধীরে ধীরে অনেক দুর্বল হয়ে পড়বে।
ফল খেতে হবে
জন্ডিস আক্রান্ত রোগীদের পেঁপে, তরমুজ, আনারস, পাকা আম, কলা,জলপাই, কমলা, এভাকোটা ও আঙ্গুরের মতো ফল খাওয়া যেতে পারে তাহলে জন্ডিস রোগীরা অনেক উপকার পাবেন।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট জাতীয় খাবার খেতে হবে
লেবু ও বাতাবি লেবু জন্ডিস রোগীদের জন্য খুবই ভালো খাবার। এই খাবারগুলো শরীরে পানির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে থাকে।
তাছাড়া এই সময়টাতে প্রতিদিন বাদাম খাওয়া যেতে পারে। তাছাড়া সামান্য আদা কুচি, রসুন কুচি, আদার রস ও আদার চা খাওয়া যেতে পারে।
পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে
প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে জন্ডিস আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে। পানি শরীর থেকে ক্ষতিকর টক্সিন উপাদান বের করে দেয়। এই সময়টাতে আখের রস ও ডাবের পানি খাওয়ার মাধ্যমে শরীরে পানির চাহিদা পূরণ করা যেতে পারে।
জন্ডিস হলে কি খাওয়া যাবেনা?
জন্ডিস হলে কি খাওয়া যাবেনা বা জন্ডিস আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে কোন কোন খাবারগুলি খাওয়া নিষেধ এই বিষয়ে অনেকেই জানেন না।
জন্ডিস আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত মিষ্টি জাতীয় খাবার, কাঁচা লবণ, অতিরিক্ত তেল মশলাযুক্ত খাবার, গরু বা ছাগলের মাংস,অ্যালকোহল ও ফ্যাট জাতীয় খাবার খাওয়া বাদ দিতে হবে।
এই খাবারগুলো খেলে জন্ডিসের মাত্রা বাড়তে পারে। তাই জন্ডিস থাকা কালীন সময়ে অবশ্যই এই খাবারগুলো খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
জন্ডিসের ঔষধের নাম?
অনেকেই জন্ডিস রোগের ঔষধ এর নাম বা জন্ডিস রোগ হলে কি ঔষধ খেতে হবে এই বিষয়ে প্রশ্ন করে থাকেন। জন্ডিস রোগীদের সর্বপ্রথম রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে বিলুরুবিনের মাত্রা কত পরীক্ষা করা উচিত।
তারপরে ডাক্তারের পরামর্শে avolac syrup, omidon tablet,solvit b syrup এই ঔষধ গুলো খাওয়ানো উচিত। তবে অবশ্যই জন্ডিস হলে ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতীত কোন ঔষধ খাওয়া উচিত হবে না।
যে ঔষধ গুলোর নাম দেওয়া হয়েছে এগুলো যেসব ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হবে তা নয়। অভিজ্ঞ ডাক্তারগণ জন্ডিস রোগীদের যে ওষুধগুলো খেতে দিবে সেগুলো খেতে হবে।
বিলিরুবিনের মাত্রা কত হলে জন্ডিস হয়?
রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা ১.২ mg এর নিচে হলে বা 3 mg dl এর বেশি হলে ডাক্তার রোগীদের জন্ডিস হয়েছে বলে ধারণা করে থাকেন। অর্থাৎ রক্তে বেলুড়ুবিনের মাত্রা যখনই ১.২ এমজির অনেক উপরে চলে যায় তখনই সেটা জন্ডিসের লক্ষণ হিসেবে প্রতিীয়মান হয়ে থাকে।
শেষ কথা, আশা করি আজকের পোস্টটি ইতিমধ্যে যারা পড়েছেন তারা জন্ডিস দূর করার ঘরোয়া চিকিৎসা ও জন্ডিস হলে কি কি সমস্যা হয় এই বিষয়ে মোটামুটি ধারণা পেয়ে গিয়েছেন।
তারপরেও যদি এই নিয়ে কোন ধরনের প্রশ্ন থাকে বা পোস্টটি পড়ে কোন বিষয়ে সম্পর্কে বুঝতে কোন ধরনের অসুবিধা হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্টের মাধ্যমে জানাতে পারেন। ধন্যবাদ।