লিভার শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। সুস্থ থাকতে হলে লিভারের খেয়াল রাখতেই হবে। অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই লিভার খারাপ হওয়ার কারণ হচ্ছে কিছু বদ অভ্যাসের জন্য।
মানুষের শরীরের সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীণ অঙ্গ হচ্ছে লিভার বা যকৃৎ। ইহা কেবল আকারেই বড় নয়, কাজেও সবার চেয়ে এগিয়ে আছে লিভার। মূলত ৫০০ ধরণের বেশি কাজ করে শরীরকে সচল রাখে আমাদের লিভার।এত বেশি দায়িত্ব যে অঙ্গের, এর গঠনশৈলীও যথেষ্ট জটিল। মস্তিস্কের পর পরেই দ্বিতীয় জটিল অঙ্গ হিসেবে লিভারকে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। গ্লুকোজের মাধ্যমে শক্তি উৎপাদন, জটিল ফ্যাট অণু ভেঙে কোলেস্টেরল আর ট্রাইগ্লিসারল তৈরি এবং ক্ষতিকর পদার্থ অপসারণের কাজ করে থাকে লিভার।
আবার খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন তৈরির কাজও করে লিভার। যেমন রক্ত জমাট বাঁধার জন্য ক্লটিং ফ্যাক্টর, যা এক ধরণের প্রোটিন। এরা মূলত লিভারেই তৈরি হয়। তাই আজকের এই আর্টিকেলে আমরা জানব লিভার সুস্থ রাখতে কি কি করতে হবে।
লিভার কি?
যকৃৎ মেরুদণ্ডী ও অন্যান্য কিছু প্রাণীদেহে অবস্থিত হল একটি অভ্যন্তরীণ অঙ্গ। মানবদেহে মধ্যচ্ছদার নিম্নে ও উপরে পাকস্থলীর ঠিক ডান পাশে যকৃৎ অবস্থিত। এর রং হচ্ছে লালচে খয়েরি।
একে চলতি বাংলায় কলিজা বলে সচরাচর উল্লেখ করা হয়ে থাকে। যকৃৎ হচ্ছে দেহের বৃহত্তম গ্রন্থি। এর ওজন হল দেহের মোট ওজনের (৩-৫%)। এটি মূলত দুইটি খণ্ডে বিভক্ত।
যেমন ডান এবং বাম। প্রাণীদেহে বিপাক ও অন্যান্য কিছু শারীরবৃত্তীয় কাজে যকৃত প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। গ্লাইকোজেনের সঞ্চয়, প্লাজমা প্রোটিন সংশ্লেষণ, ঔষুধ বা অন্যান্য রাসায়নিক নির্বিষকরণে এর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
যকৃতে মূলত পিত্তরস উৎপন্ন হয়, পিত্তরস একধরণের ক্ষারীয় যৌগ যা পরিপাকে সহায়তা করে থাকে। বিশেষত স্নেহজাতীয় খাদ্যের ইমালসিফিকেশনের জন্য পিত্তরস প্রয়োজন। এছাড়াও যকৃৎ দেহের আরও কিছু জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। যকৃৎ কে রসায়ন এর গবেষণাগারও বলা হয়।
যকৃৎ বা লিভার এর কাজ?
যকৃৎ থেকে পিত্তরস নিঃসৃত হয় মূলত যা খাদ্য পরিপাকের, বিশেষ করে স্নেহজাতীয় খাদ্য পরিপাকের, একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান৷ যকৃতে মূলত ইউরিয়া তৈরি হয়। এছাড়াও যকৃতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া সংঘটিত হয়ে থাকে৷
এজন্য যকৃতকে মূলত দেহের জৈব রসায়নাগার বলা হয়। যকৃত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি কাজের মধ্যে যেমনঃ
- রক্তের প্লাজমা প্রোটিন মূলত যকৃতে সংশ্লেষিত হয়৷
- যকৃতে পিত্তরস তৈরী হয় এবং যা যকৃত থেকে নিঃসৃত হয়ে পিত্তথলিতে জমা থাকে। এবং প্রয়োজন অনুযায়ী অন্ত্রে পিত্তরসের সরবরাহ ঘটে।
- রক্তের অতিরিক্ত গ্লুকোজ যকৃতে গ্লাইকোজেন রূপে সঞ্চিত হয়ে থাকে এবং প্রয়োজনে গ্লাইকোজেন
- ভেঙ্গে রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা সঠিক রাখে ৷
- যকৃতে ভিটামিন (A,D,E,K,B6 ও B12) সঞ্চিত হয়ে থাকে৷
- বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়ার ফলে মানবদেহে উৎপন্ন বিষ জাতীয় পদার্থ যকৃত কোষের অভ্যন্তরে
- রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে প্রশমিত হয়ে থাকে।
- যকৃতে লৌহিত রক্তকণিকার হিমোগ্লোবিন ভেঙ্গে মূলত বিলিরুবিন ও বিলিভার্ডিন সৃষ্টি হয়ে থাকে।
লিভার রোগের প্রকারভেদ?
লিভারের রোগগুলোকে সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমনঃ
- জেনেটিক
- সংক্রমণজনিত
- লাইফস্টাইলঘটিত
জীবনযাপন জনিত কারণেই মূলত দেখা দেয় ফ্যাটি লিভার ডিজিজ হেপাটাইটিসের অনেক কারণের মধ্যে সংক্রমণ একটি ফ্যাক্টর। আর লিভারে কপার বা আয়রন জমার ফলে যে সমস্যা তৈরি হয় সেটা হচ্ছে জেনেটিক।
অতিরিক্ত আয়রন জমেও এই সমস্যা তৈরি হতে পারে। আর এটিকে বলা হয় হিমোক্রোমাটোসিস। ফ্যাটি লিভার ডিজিজ এটিকে দুইটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমনঃ
- নন-অ্যালকোহলিক
- অ্যালকোহলিক
যদি অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে কখনও লিভারে ফ্যাট জমে তাহলে তাকে বলা হয় অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার। এটি ধরা পড়লে রোগীকে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। এবং অবশ্যই মদ্যপান পরিহার করতে হবে। লিভারে যে ছয়টি অসুস্থতা হতে পারে। যেমনঃ
- লিভার ক্যান্সার
- লিভারের ফোঁড়া
- ভাইরাল হেপাটাইটিস (যা জন্ডিস নামে পরিচিত)
- লিভার সিরোসিস
- পিত্তথলির বা পিত্তনালীর রোগ
- লিভারের জন্মগত ও মেটাবলিক রোগ ইত্যাদি।
যে পাঁচটি কারণে লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়?
- হেপাটাইটিস বা প্রদাহ হলে
- রক্ত সঞ্চালন বাধা পেলে
- কোলেসটাসিস বা পিত্তনালীতে কোন বাধা তৈরি হলে
- কোলেস্টেরল হলে
- দূষিত পদার্থ থেকে টিস্যু নষ্ট হয়ে গেলে লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়
লিভার অসুস্থ হওয়া ১২টি লক্ষণ?
- উপর পেটের ডানদিকে ব্যথা
- নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধ
- চোখের কোলে কালি ও চোখে ফোলাভাব
- ঘামে দুর্গন্ধ
- মুখের চামড়ায় বাদামি দাগ
- জিভে ময়লা জমে থাকা
- পেটের উপরি ভাগে মেদ জমা
- হাত পায়ের পাতায় চুলকানি
- জন্ডিস হলে চামড়া ও চোখ হলদে হয়ে যাওয়া
- বমিভাব বা জ্বর
- ওজন বাড়া বা কমা ও হজমে সমস্যা হলে
- ইরিটেবল বোয়েল সিনড্রোম ইত্যাদি।
লিভার সুস্থ রাখতে যে সকল খাবার গ্রহণীয় ও বর্জনীয়?
মূলত অতিরিক্ত ওজন, ডায়াবেটিস, রক্তে অতিরিক্ত মাত্রায় ট্রাইগ্লিসারাইড এবং কম গুড কোলেস্টেরল কিংবা এইচডিএল, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, কার্বোহাইড্রেট ও চর্বির বিপাকে সমস্যার কারণে যকৃতে চর্বি জমে।
এই সমস্যা গুলো থেকে মুক্তি পেতে হলে অবশ্যই সঠিক খাদ্যাভ্যাস, ওজন নিয়ন্ত্রণ ও ব্যায়ামের কোন বিকল্প নেই।
যে সকল খাবার গ্রহণীয়?
সবুজ শাকসবজি
প্রতিদিন সবুজ শাকসবজি বিশেষ করে যেমন শালগম, পালংশাক, ব্রকলি ও বাঁধাকপি খাবারের তালিকায় রাখতে হবে।
কোলিন যুক্ত খাবার
যকৃতের চর্বি কাটাতে কোলিন যুক্ত খাবার যেমনঃ
- সয়াবিন
- ইলিশ
- পুঁটি মাছ
- চিংড়ি
- চিনাবাদাম
- স্যামন
- ফুলকপি
- ডিম
বিচি জাতীয় খাবার
সূর্যমুখীর বিচি, শিমের বিচি, কুমড়ার বিচি এছাড়াও রেড কিডনি বিনসে প্রচুর ভিটামিন-ই এবং অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট রয়েছে। এই উপাদান ফ্যাটি লিভারের জন্য খুবই উপকারী।
জটিল শর্করা
শর্করার উৎস হিসেবে অবশ্যই জটিল আঁশযুক্ত শর্করা বেছে নিতে হবে। এক্ষেত্রে যেমন ব্রাউন রাইস, ওটস,, হোল গ্রেইন আটা ইত্যাদি।
ওমেগা-৩ যুক্ত খাবার
ওমেগা-৩ যুক্ত খাবার সাধারণত যকৃতের চর্বি কমাতে সাহায্য করে। সামুদ্রিক মাছ যেমন সার্ডিন, টুনা, স্যামন, কাঠবাদাম, ওয়ালনাট, ফ্ল্যাক্সসিড এবং অলিভ ওয়েল খেতে হবে নিয়মিত।
দুগ্ধজাত খাবার
প্রতিদিন পরিমাণমতো দুধ কিংবা দই খেতে হবে। এতে থাকা প্রোটিন যকৃৎকে ভাল রাখতে সাহায্য করে।
যে সকল খাবার বর্জনীয়?
শর্করা, বিশেষ করে সহজ শর্করা আপনাকে অবশ্যই কমিয়ে দিতে হবে। মূলত অতিরিক্ত শর্করাই চর্বি হিসেবে যকৃতে জমা হয়ে থাকে। তাই মিষ্টি এবং চিনিযুক্ত খাবার, কোমল পানীয়, সাদা ভাত, চকলেট, আইসক্রিম, মিষ্টান্ন বা ডেজার্ট ও বেকারির খাবার যতটা সম্ভব খাওয়া কমিয়ে দিন।
এছাড়াও সাদা আটা, অ্যালকোহল, তেলে ভাজা খাবার, কাঁচা লবণ, রেড মিট (গরু-খাসির মাংস) এসব এড়িয়ে চলতে হবে।
ঘরোয়া পদ্ধতির লিভার পরিষ্কার রাখার ৭টি উপায়?
১. প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে পানি খেতে হবে। পানি হচ্ছে সেরা ফ্লাশিং এজেন্ট। এটি আপনার লিভার ও কিডনি পরিষ্কার করতে অনেকটাই সাহায্য করে। এজন্য প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ গ্লাস পানি অবশ্যই পান করতে হবে।
এছাড়াও সম্ভব হলে ডিটক্স ওয়াটারও পান করতে পারেন। সেক্ষেত্রে আদার টুকরো, শসা, লেবুর স্লাইস ও কিছু পুদিনা পাতা সারারাত ভিজে রেখে সকালে ওই পানি পান করুন।
২. লিভার ভাল রাখতে হলে দৈনিক চিনি খাওয়ার পরিমাণ আপনাকে ২০ থেকে ৩০ গ্রাম বা তার কম রাখতে হবে। মূলত এর কারণ হচ্ছে রক্তে অতিরিক্ত চিনি মূলত লিভারের কার্যকারিতা নিঃশেষ করে দিতে পারে।
৩. অতিরিক্ত ওজনের কারণে অনেকেই লিভারের সমস্যায় ভোগে থাকেন। এজন্য ব্যায়ামের কোন বিকল্প নেই। নিয়মিত শরীরচর্চার মাধ্যমে অতিরিক্ত ওজন, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও রক্তে চর্বির পরিমাণও কমায়।
এবং একই সঙ্গে ফ্যাটি লিভারের সমস্যা অথবা লিভার সিরোসিস (প্রদাহ ও দাগ) থেকেও রক্ষা পাবেন নিয়মিত ব্যায়াম করলে।
৪. অস্বাস্থ্যকর চর্বি এবং লবণযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন। এতে করে লিভার দ্রুত পরিষ্কার হবে। অস্বাস্থ্যকর চর্বিজাতীয় খাবার ফ্যাটি লিভার এবং লিভার সিরোসিস হওয়ার মূল কারণ।
এর বদলে বাদাম, আখরোট, নারকেল, চিয়া বীজ, ফ্লেক্স বীজ, কুমড়ার বীজ, ডিম এবং চর্বিযুক্ত মাছ (স্যামন) খেতে পারেন।
৫. অতিরিক্ত অ্যালকোহল পান করা মোটেও স্বাস্থ্যের জন্য ভাল নয়। অ্যালকোহলযুক্ত ফ্যাটি লিভার হওয়ার আশঙ্কা অনেকটাই বাড়িয়ে দেয় এই বদাভ্যাসে। এবং লিভারের কার্যকারিতাও ব্যাহত হয় এর ফলে। তাই যতটা সম্ভব অ্যালকোহল থেকে দূরে থাকুন।
৬. সুস্থ লিভারের জন্য মেডিটেশন ও ইয়োগা করাও অত্যান্ত জরুরি। এর মাধ্যমে মূলত আপনার স্ট্রেস ম্যানেজ করুন। এটি আপনার কর্টিসলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে অনেকটাই সাহায্য করে। যা আপনার লিভার এর উপর চাপ কমাতে পারে।
৭. লিভার পরিষ্কার করতে হলে অবশ্যই খাদ্যতালিকায় পুষ্টিকর খাবার রাখুন। এজন্য অবশ্যই আপনাকে অর্গানিক শাক-সবজি ও ফল-মূল রাখতে হবে। যা আপনার লিভারকে অনেটাই সুস্থ রাখবে।
একই সঙ্গে রসুন, হলুদ, সাইট্রাস ফল, আখরোট, বিট, সবুজ চা, গাজর, আপেল ও অ্যাভোকাডো খাদ্যতালিকায় অবশ্যই রাখুন।