বেশিরভাগ সময়েই পেট ব্যথা তেমন কোন গুরুতর রোগের কারণে হয় না। কয়েকদিনের মাঝেই ইহা সেরে যায়। আপনারা যারা পেট ব্যথা সংক্রান্ত সমস্যায় ভুগছেন। তাদের জন্য আজকের এই আর্টিকেল।এই পোস্টটি থেকে পেটে ব্যথা কেন হয়, পেট ব্যথা কমানোর উপায় ওষুধ, পেটে ব্যথা হলে করণীয়, পেট ব্যথার ট্যাবলেট, মেয়েদের/ছেলেদের তলপেটে ব্যথা কমানোর উপায় ইত্যাদি জানতে পারবেন।
পেটে ব্যথা কেন হয়?
পেটে ব্যথা হল একটি সাধারণ ব্যাধি। যা বয়স কিংবা লিঙ্গ নির্বিশেষে অনেক লোককে প্রভাবিত করে থাকে। ইহা পেটে ব্যথা বা অস্বস্তি বুঝায়, যা তীব্রতা, সময়কাল ও অবস্থানে পরিবর্তিত হতে পারে।
যেমনঃ বদহজম, গ্যাস, কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া, ফুড পয়জনিং, আলসার, সংক্রমণ ও অ্যাপেনডিসাইটিস, পিত্তথলোর পাথর কিংবা প্যানক্রিয়াটাইটিসের মতো আরও গুরুতর অবস্থাসহ বিভিন্ন কারণের কারণে আপনার পেটে ব্যথা হতে পারে।
বদহজম হল পেট ব্যথার অন্যতম সাধারণ কারণ। ইহা ঘটে যখন পেট সঠিকভাবে খাবার হজম করতে অক্ষম হয়, যার ফলে অস্বস্তি, ফোলাভাব ও বমি বমি ভাব হয়।
অতিরিক্ত খাওয়া, খুব দ্রুত খাওয়া, মশলাদার কিংবা চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া ও মানসিক চাপসহ বিভিন্ন কারণের কারণে আপনার বদহজম হতে পারে।
ইহা সাধারণত ট্রিগারকারী খাবার এড়িয়ে, ছোট খাবার খাওয়া ও অ্যান্টাসিড বা অন্যান্য হজম সহায়ক ওষুধ গ্রহণ করে উপশম হতে পারে। পেটে ব্যথার আরেকটি সাধারণ কারণ হচ্ছে পেটে প্রচুর গ্যাস হওয়া।
এটি ঘটে যখন অন্ত্রে গ্যাস জমা হয় ও যার ফলে ফোলাভাব, ক্র্যাম্প ও ব্যথা হয়। মটরশুটি, ব্রকলি ও বাঁধাকপির মতো নির্দিষ্ট খাবার খাওয়া, খাওয়া কিংবা পান করার সময় বাতাস গিলে ফেলা ও কোষ্ঠকাঠিন্যসহ বিভিন্ন কারণে গ্যাস হতে পারে।
ইহা সাধারণত ওভার-দ্য-কাউন্টার গ্যাসের ওষুধ গ্রহণ করে কিংবা খাদ্যতালিকাগত পরিবর্তন করে উপশম হতে পারে। কোষ্ঠকাঠিন্য পেটে ব্যথার কারণও হতে পারে, বিশেষ করে যদি এটি দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে।
এটি ঘটে যখন অন্ত্রের চলাচল খুব কম কিংবা কঠিন হয়ে যায়, যার ফলে অস্বস্তি, ফোলাভাব ও ব্যথা হয়। কম ফাইবারযুক্ত খাদ্য, ডিহাইড্রেশন, ব্যায়ামের অভাব ও কিছু ওষুধসহ বিভিন্ন কারণের কারণে কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে।
ইহা সাধারণত খাদ্যতালিকাগত ও জীবনধারা পরিবর্তন করে উপশম হতে পারে। যেমনঃ বেশি ফাইবার খাওয়া, আরও জল পান করা ও নিয়মিত ব্যায়াম করা। পেটে ব্যথার আরেকটি সাধারণ কারণ হচ্ছে ডায়রিয়া।
ইহা ঘটে যখন অন্ত্রগুলো স্ফীত হয়, যার ফলে আলগা কিংবা জলযুক্ত মল, ক্র্যাম্প এবং ব্যথা হয়। ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ, খাদ্যে বিষক্রিয়া এবং ওষুধসহ বিভিন্ন কারণের কারণে ডায়রিয়া হতে পারে।
সাধারণত হাইড্রেটেড থাকা, বিশ্রাম নেওয়া ও ওভার-দ্য-কাউন্টার ডায়রিয়ার ওষুধ খাওয়ার মাধ্যমে এটি উপশম করা যেতে পারে। পেটে ব্যথার আরও গুরুতর কারণগুলোর মধ্যে হচ্ছে আলসার।
ইহা সংক্রমণ ও প্রদাহজনক অন্ত্রের রোগ। আলসার হল খোলা ঘা যা পেট বা অন্ত্রের আস্তরণে বিকশিত হয়। যার ফলে ব্যথা, রক্তপাত ও অন্যান্য উপসর্গ দেখা দেয়। বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস কিংবা পরজীবীর কারণে সংক্রমণ হতে পারে।
যার ফলে জ্বর, ডায়রিয়া ও অন্যান্য উপসর্গ দেখা দেয়। প্রদাহজনক অন্ত্রের রোগ হচ্ছে এমন একটি গোষ্ঠীকে বুঝায়। যা পরিপাকতন্ত্রের প্রদাহ ও ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে।
যার ফলে দীর্ঘস্থায়ী পেটে ব্যথা, ডায়রিয়া ও অন্যান্য উপসর্গ দেখা দেয়। আর এই অবস্থার সাধারণত চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন।
কেমন হতে পারে পেটে ব্যথার ধরণ?
গ্যাস্ট্রিকের বানপেপটিক আলসার এর ব্যাথা সাধারণত পেটের ওপর দিকে মাঝখানে শুরু হয়। ইহা খালি পেটে বাড়ে, কখনো চিনচিনে, কখনো আবার জ্বালাপোড়ার মতো মনে হয়। এর সঙ্গে থাকে বমিভাব, টক ঢেকুর ও পেট ফাঁপা ইত্যাদি।
এ ধরনের লক্ষণে অ্যান্টাসিড কিংবা অন্য গ্যাস্ট্রিকের ওষুধে বেশ উপশম মেলে। একই জায়গায় বা একটু বাঁ দিকে অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ হতে পারে। কিন্তু এই ব্যথা প্রচণ্ড তীব্র, পেছন দিকেও অনুভূত হয়। রোগী ব্যথায় কুঁকড়ে যায়।
সামনে ঝুঁকে থাকলে আরাম মেলে। সঙ্গে বমি থাকতে পারে। তলপেটে ব্যথার সঙ্গে প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া এবং জ্বর প্রস্রাবের সংক্রমণ নির্দেশ করে। মেয়েদের জরায়ু এবং ডিম্বাশয়ের নানা ধরনের সমস্যায় ব্যথা হতে পারে।
নাভির মাঝখান থেকে ব্যথা যদি ক্রমশই তলপেটের ডান দিকে ছড়িয়ে যায়। সেখানে হাত দিলেই যদি ব্যথা হয়, আস্ত আস্ত তীব্রতা বাড়তে থাকে, তবে তা অ্যাপেন্ডিসাইটিস কি না, তা ভাবতে হবে।
পিত্তথলিতে প্রদাহ কিংবা পাথর থাকলে ওপরের পেটের ডান দিকে ব্যথা হতে পারে। আর এই ব্যথাও ডান দিকে পেছন পর্যন্ত ছড়ায়, সঙ্গে বমিও হতে পারে। বিশেষ করে চর্বিযুক্ত খাবার খেলে ইহা আরও বাড়ে।
যকৃতের প্রদাহের ক্ষেত্রেও একই জায়গায় ব্যথা হয়। চিনচিন করে ব্যথা, সঙ্গে জ্বর, জন্ডিস, অরুচি ইত্যাদি হেপাটাইটিস কিংবা যকৃতে প্রদাহ নির্দেশ করে থাকে। যকৃতে ফোঁড়া হলে এই ব্যথা তীব্র হয় ও সঙ্গে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে।
পেটের ওপরের দিকে ডান অথবা বাঁ কিডনিতে পাথর, প্রদাহ কিংবা সংক্রমণ হলে সেই পাশে এবং পেছনে ব্যথা হয়। আর এই ব্যথা ক্রমেই নিচে নেমে তলপেটেও ছড়ায়।
কিডনির ব্যথা প্রচণ্ড তীব্র হয় ও একটু পরপর ছাড়ে, আবার আসে। সঙ্গে বমি ও কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসতে পারে। সাধারণ আমাশয়, ফুড পয়জনিং এবং বদহজম থেকে ব্যথা পেটজুড়ে থাকে। এছাড়াও বমি বমি ভাব, পেটে শব্দ ও পাতলা পায়খানা ইত্যাদি হয়।
আবার অনেক কোষ্ঠকাঠিন্য থেকেও পেটে ব্যথা হয়। দীর্ঘদিনের পেটের ব্যথার সঙ্গে ওজন হ্রাস, রক্তশূন্যতা ও দুর্বলতা ইত্যাদি সতর্কসংকেত। অন্ত্রে ক্যানসার কিংবা টিবিরও লক্ষণ এই পেটে ব্যথা। আর তাই পেটের ব্যথাকে কখনো ছোট করে দেখবেন না।
পেট ব্যথা হলে কখন ডাক্তারের সহায়তা নিবেন?
- বারবার পেট ব্যথা বা পেট ফেঁপে ওঠার সমস্যা হতে থাকলে।
- কোন কারণ ছাড়াই শরীরের ওজন কমতে থাকে।
- পেট ব্যথা কিংবা পেট ফাঁপা দীর্ঘ সময় ধরে থাকে ও সহজে সারতে চায় না।
- পেটে চাকার মত মনে হলে।
- আয়রনের অভাবজনিত।
- রক্তশূন্যতায় ভোগলে।
- পেট ব্যথার পাশাপাশি খাবার গিলতে সমস্যা হয় ও খাবার গলায় আটকে যায়।
- হঠাৎ করেই আপনার প্রস্রাব স্বাভাবিকের চেয়ে কম কিংবা বেশী বার হয়।
- ঘন ঘন বমি হলে।
- পায়খানার রাস্তা বা যোনিপথ তথা মাসিকের রাস্তা দিয়ে রক্ত যায়।
- কিংবা মাসিকের রাস্তা দিয়ে এমন স্রাব যায় যা খুবই অস্বাভাবিক।
- ডায়রিয়া যদি কিছু দিনের মধ্যে সেরে না ওঠে।
- প্রস্রাব করার সময় আপনি ব্যাথা অনুভব করে থাকেন।
ডাক্তারকে যেসব বিষয় নিয়ে আপনি জিজ্ঞেস করতে পারেন, সেগুলো হচ্ছেঃ
- পেট ব্যথা হওয়ার সম্ভাব্য কারণ কি হতে পারে।
- কোষ্ঠকাঠিন্য এবং বদহজমের জন্য কোন ধরনের ওষুধ খাওয়া যেতে পারে।
- কী করলে পেট ব্যথা কমতে পারে।
পেটে ব্যথা হলে করণীয়?
আপনি যদি পেটে ব্যথা অনুভব করেন। তবে আপনি হয়তো এই সমস্যা থেকে মুক্তির পথ খুঁজছেন। পেটে ব্যাথা বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য, গ্যাস বা এমনকি মানসিক চাপের মতো বিভিন্ন কারণের কারণে হতে পারে।
আপনার পেটের অস্বস্তি কমাতে ও ভাল বোধ করতে আপনি নিতে পারেন এমন বেশ কয়েকটি পদক্ষেপঃ
হাইড্রেটেড থাকুন
প্রচুর তরল পান করা পেটের ব্যাথা কমাতে সাহায্য করতে পারে। বিশেষ করে যদি এটি কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণে হয়ে থাকে। প্রতিদিন কমপক্ষে ৮ থেকে ১০ গ্লাস পানি পান করুন।
কিছু খাবার এড়িয়ে চলুন
কিছু কিছু খাবার আপনার পেট ব্যথা আরও খারাপ করে দিতে পারে। যেমনঃ মশলাদার, চর্বিযুক্ত বা চর্বিযুক্ত খাবারের পাশাপাশি ক্যাফেইন, অ্যালকোহল ও কার্বনেটেড পানীয় এড়িয়ে চলুন।
তাপ প্রয়োগ করুন
আপনার পেটে একটি হিটিং প্যাড কিংবা গরম পানির বোতল রাখলে ক্র্যাম্পিংয়ের কারণে পেটের ব্যথা উপশম হতে পারে।
ওভার-দ্য-কাউন্টার ওষুধ ব্যবহার করে দেখুন
অ্যান্টাসিড, যেমনঃ Tums কিংবা Rolaids বদহজমের কারণে পেটের ব্যাথা উপশম করতে সাহায্য করতে পারে। আপনার যদি ডায়রিয়া হয় তবে সেক্ষেত্রে আপনি ডায়রিয়ার ঔষুধ ব্যবহার করতে পারেন।
বিশ্রাম
বিশ্রাম নেওয়া ও সহজে গ্রহণ করা স্ট্রেস বা উদ্বেগের কারণে পেটের ব্যথা উপশম করতে সহায়তা করতে পারে।
একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন
আপনার যদি পেটে ব্যথা তীব্র, অবিরাম কিংবা অন্যান্য উপসর্গের সাথে থাকে। যেমনঃ জ্বর, বমি বা আপনার মলে রক্ত, তাহলে একজন ডাক্তারের সাথে দেখা করা আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
তারা আপনার পেট ব্যথার অন্তর্নিহিত কারণ নির্ধারণ করতে ও উপযুক্ত চিকিৎসা প্রদান করতে সাহায্য করতে পারবে।
কেমন পেট ব্যথা হলে জরুরী ভিত্তিতে হাসপাতালে যাবেন?
- ব্যথা খুব দ্রুত খারাপ হয়ে যায় কিংবা গুরুতর রূপ ধারণ করে।
- একেবারে হঠাৎ করেই পেট ব্যথা শুরু হয় কিংবা ব্যথা প্রচণ্ড তীব্র হয়।
- প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যায়।
- পেটে স্পর্শ করলে সেই জায়গা ব্যথা করে।
- বমির সাথে রক্ত যায় বা বমির রং কফিদানার মত কালচে বাদামী হয়।
- রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়।
- পায়খানার সাথে রক্ত যায় বা পায়খানা কালো, আঠালো এবং প্রচণ্ড দুর্গন্ধযুক্ত হয়।
- পায়খানা বা বায়ু ত্যাগ বন্ধ হয়ে যায়।
- শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
- বুকে ব্যথা হয়।
- ডায়বেটিস আছে এমন কারো বমি হলে।
আর এসব লক্ষণ মারাত্মক কোন রোগের কারণে হতে পারে। আর তাই দ্রুত চিকিৎসা না পেলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাই দেরি না করে অবশ্যই দ্রুত রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাবেন।
সাবধনতা
ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোন ধরনের ওষুধ সেবন করা আপনার স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।