থ্যালাসেমিয়া রোগটি উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া একটি মারাত্মক রোগ। রোগী থ্যালাসেমিয়া তে আক্রান্ত হলে রক্তের ব্যাধি হয়ে থাকে যার কারণে শরীরের হিমোগ্লোবিন ও লোহিত রক্তকনিকা তৈরিতে অসুবিধা হয়ে থাকে। সারা বিশ্বজুড়ে থ্যালাসেমিয়া রোগী রয়েছে।তবে সময়ের সাথে সাথে যেন এশিয়ার দেশগুলোতেও থ্যালাসেমিয়া রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আজকের আর্টিকেলের মূল আলোচনায় থাকছে থ্যালাসেমিয়া কি, থ্যালাসেমিয়া কেন হয়, থ্যালাসেমিয়া রোগের লক্ষণ ও থ্যালাসেমিয়া রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি।
থ্যালাসেমিয়া কি?
থ্যালাসেমিয়া রোগটি হচ্ছে এক ধরনের রক্তের ব্যাধি।কারো থ্যালাসেমিয়া হলে শরীরের হিমোগ্লোবিন রক্ত তৈরি করতে পারে না অর্থাৎ রক্ত তৈরি করা কোষ ধ্বংস হয়ে যায়। থ্যালাসেমিয়া রোগটি শিশুদের বেশি হয়ে থাকে।
তবে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যেও থ্যালাসেমিয়া রোগ হওয়ার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থ্যালাসেমিয়া রোগটি উত্তরাধিকার সূত্রে হয়ে থাকে।
থ্যালাসেমিয়া কেন হয়?
থ্যালাসেমিয়া বংশগত রক্তস্বল্পতা জনিত এক ধরনের রোগ। এটি কোন ধরনের ছোঁয়াচে রোগ নয়। সাধারণত জিনগত ক্রুটির কারণে যখন রক্তের হিমোগ্লোবিন অতিরিক্ত হারে বেড়ে যায় তখন লোহিত রক্তকণিকা ভেঙে থ্যালাসেমিয়া সৃষ্টি হয়।
থ্যালাসেমিয়া রোগ হলে রক্তশূন্যতা দেখা দিয়ে থাকে। বাবা মা উভয়েই যদি থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক হয়ে থাকেন তাহলে তার সন্তানদের থ্যালাসেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আমাদের মানবদেহে মোট ৪৬টি ক্রোমোজোম থাকে।
যার মধ্যে অর্ধেক আসে মায়ের কাছ থেকে আর অর্ধেক বাবার কাছ থেকে। এই ১৬ নম্বার ক্রোমোজোমে থাকে আলফা জিন ও ১১ নাম্বার যে ক্রমোজোমটি রয়েছে সেটাতে বিটা জিন থাকে।
আর এই আলফা এবং বিটা জিন গ্লোবিন নামের এক ধরনের প্রোটিন তৈরি করে থাকে যা আ্যামিনো এসিডের সমষ্টি। এই দুটি ক্রোমোজোম যদি সঠিকভাবে আ্যামিনো কোন এসিড তৈরি করতে না পারে তাহলে হিমোগ্লোবিনো ত্রুটি পূর্ণ হয়।
এর ফলে সাধারণ মানুষের লোহিত রক্তকণিকার গড় আয়ু ১২০ দিন হলেও কোটিপুন্ন লোহিত রক্ত কণিকার গড় আয়ু ২০ থেকে ৬০ দিন হয়ে থাকে। অর্থাৎ লোহিত রক্তকণিকা ভেঙ্গে যায় যার কারণে রক্তশূন্যতা বা থ্যালাসেমিয়ার মত রোগের সৃষ্টি হয়।
থ্যালাসেমিয়া রোগের লক্ষণ কী?
রক্তস্বল্পতার মাধ্যমে অনেকের থ্যালাসেমিয়া রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেয়ে থাকে। তাছাড়া জরিপে দেখা গিয়েছে আরো কয়েকটি লক্ষণ থ্যালাসেমিয়া রোগীদের ক্ষেত্রে দেখা যায় যেমন:-ক্লান্তি, অবসাদ, শ্বাসকষ্টের মত সমস্যা।
তাছাড়া থ্যালাসেমিয়া তে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে জন্ডিসের মতো রোগ হতে পারে। কেননা রক্ত যখন অধিক হারে ভেঙে যায় তখন জন্ডিসের লক্ষণ দেখা দেয়।
শিশুর থ্যালাসেমিয়া রোগের লক্ষণ?
থ্যালাসেমিয়া রোগটি শিশু অবস্থায় প্রকাশ পেয়ে থাকে। বিটা থ্যালাসেমিয়া এবং কিছু ধরনের আলফা থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের ৬ মাসের মধ্যে কোন ধরনের লক্ষণ প্রকাশ পায় না। তারপরে ধীরে ধীরে থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ দেখা যায়। যেমনঃ
- জন্ডিস ও ত্বক ফ্যাকাসে হয়ে যেতে পারে বেশিরভাগ শিশুর ক্ষেত্রে থ্যালাসিমিয়া রোগটি জন্ডিস আকারে লক্ষণ হিসেবে প্রকাশ পায়।
- থ্যালাসেমিয়া হলে শিশুদের বুকে ব্যথা হতে পারে এবং হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যেতে পারে।
- থ্যালাসেমিয়া হলে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় এবং পায়ে ক্রাম্পের মত সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।
- থ্যালাসেমিয়ার কারণে শিশুদের বৃদ্ধিতে ত্রুটি দেখা দিতে পারে অর্থাৎ শিশু বৃদ্ধি সঠিকভাবে হয় না।
- শিশুদের মাথা ঘোরা ও অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মত সমস্যা হতে পারে।
থ্যালাসেমিয়া রোগের চিকিৎসা?
থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত গুরুতর রোগীদের ক্ষেত্রে স্ট্যান্ডার্ড চিকিৎসা হলো মূলত রক্ত সঞ্চালন ও আয়রন কেলেশন। অর্থাৎ রোগীকে নতুন রক্ত সঞ্চালনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে যেন হিমোগ্লোবিনের স্বাভাবিক মাত্রাটা বজায় থাকে।
যারা থ্যালাসেমিয়ায় মাঝারি ও মারাত্মক পর্যায়ে রয়েছে তাদের প্রতি চার মাস অন্তর অন্তর রক্ত সঞ্চালনের ব্যবস্থা করতে হবে অর্থাৎ নতুন রক্ত দিতে হবে। আর বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর রোগীদের ক্ষেত্রে দুই থেকে চার সপ্তাহ পর পর রক্ত সঞ্চালনার ব্যবস্থা করতে হবে।
তাছাড়া আয়রন কেলেশন করে শরীর থেকে অতিরিক্ত লৌহ অপসারণ করে ফেলতে হবে। অনেকের রক্ত সঞ্চালনের সময় লৌহ ওভারলোড হওয়ার সম্ভাবনা থেকে থাকে যা রোগীর অন্যান্য অঙ্গ গুলির ক্ষতিসাধন করতে পারে।
তাই রোগীকে ঘন ঘন রক্ত সঞ্চালনের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি অবশ্যই আয়রন কেলেশন থেরাপির প্রয়োজন হবে। থ্যালাসেমিয়া কোন ডোনার অথবা দাতার কাছ থেকে অস্থি মজ্জা এবং স্টেম সেল ট্রান্সপ্ল্যান্ট করার মাধ্যমেও নিরাময় করার যায়।
এটিই হচ্ছে আধুনিকভাবে থ্যালাসেমিয়ার সব থেকে কার্যকারী চিকিৎসা। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই ডোনারের শরীরের প্রোটিন থ্যালাসেমিয়াতে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রোটিনের সাথে মিল থাকতে হবে। এই পদ্ধতিটির নাম হলো হিউম্যান লিউকোসাইট অ্যান্টিজেন।
অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের পর এক মাসের মধ্যে প্রতিস্থাপিত অস্থি মজ্জা স্টেম সেলগুলি নতুন করে সুস্থ রক্ত কোষ তৈরি করতে শুরু করে থাকে। যারা গুরুতর রোগী তাদেরকে সাধারণত এই চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে।
থ্যালাসেমিয়া রোগের হোমিও চিকিৎসা?
অনেক হোমিওপ্যাথিক ডাক্তাররা সরাসরি দাবি করছে থ্যালাসেমিয়া সাধারণ পর্যায়ে থাকলে হোমিও চিকিৎসার মাধ্যমে সম্পূর্ণভাবে নিরাময় করা সম্ভব।
আর যাদের এই রোগটি গুরুতর পর্যায়ে চলে গিয়েছে তারা যদি হলো চিকিৎসাতে যান তাহলে ধীরে ধীরে রোগীর অবস্থার উন্নতি হওয়া শুরু করে এবং যেখানে চার সপ্তাহ পরপর রক্ত দেওয়া লাগতো সেখানে বছরে দুইবার রক্ত দিলেই চলে।
কেননা হোমিও চিকিৎসকরা রোগের সকল অবস্থার পর্যবেক্ষণ সহ মানসিক ও শারীরিকভাবে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করে থাকেন।
থ্যালাসেমিয়া কি ব্লাড ক্যান্সার?
থ্যালাসেমিয়া হলো বংশগত রক্তের একটি রোগ। এই রোগটি যখন হয়ে থাকে তখন রক্তে অক্সিজেন পরিবহনকারী হিমোগ্লোবিন কণার উৎপাদনের ত্রুটি সৃষ্টি হয়ে থাকে।
থ্যালাসেমিয়া তে আক্রান্ত রোগীর রক্তশূন্যতাতে ভুগে থাকেন তাই এতে ব্লাড ক্যান্সারের কোন সম্ভাবনা নেই।
থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগী কত বছর বাঁচে?
থ্যালাসেমিয়া রোগীর গড় আয়ু কত বা থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগী কত বছর বাঁচে এই নিয়ে অনেকের প্রশ্ন রয়েছে। থ্যালাসেমিয়া রোগীকে নিয়মিত নিরাপদ রক্ত নেওয়া, আয়রন চিলেশন,ডোনারের অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন ও জিনথেরাপির মত চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে।
তবে এই চিকিৎসা গুলো অনেক ব্যয়বহুল হয়ে থাকে যা অনেকের পক্ষে করানো সম্ভব হয় না। থ্যালাসেমিয়া রোগীকে যদি সঠিক চিকিৎসা দেওয়া যায় তাহলে ৩০ বছরের বেশি বাঁচানো সম্ভব।
শেষ কথা, থ্যালাসেমিয়া রোগের চিকিৎসা বা কিভাবে রোগটির বিপক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন আশা করি পোস্টটি পড়ার মাধ্যমে এই বিষয়ে মোটামুটি ধারণা পেয়ে গিয়েছেন। তাই রোগটির বিষয়ে অবশ্যই সচেতন থাকুন এবং অন্যদের এই বিষয়ে অবগত করুন।
তাছাড়া পোস্টটি পড়ে কোন বিষয়ে সম্পর্কে বুঝতে যদি কোন ধরনের অসুবিধা হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাতে পারেন। ধন্যবাদ।